চিনের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলির বিবরণ দাও

অসম চুক্তি বা বৈষম্যমূলক চুক্তি : চিনে কিং বা চিং  বংশের বা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী তাদের সামরিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শক্তিগুলি দেশ চীনকে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য প্রসারিত করে, এর উপর বেশ কয়েকটি একতরফা শোষণমূলক চুক্তি চাপিয়ে দেয়। এই চুক্তিগুলি সাধারণত ‘অসম চুক্তি’ বা ‘বৈষম্যমূলক চুক্তি’ হিসাবে পরিচিত।

চিনের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলির বিবরণ দাও
চিনের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলির বিবরণ দাও

চিনের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলি হল :

1) নানকিং-এর অসম চুক্তি :- প্রথম আফিমের যুদ্ধে চিন পরাস্ত হয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে নানকিং এর অসম সন্ধি ২৯ শে আগস্ট ১৮৪২ খ্রিঃ স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধির দ্বারা ক্যান্টন, সাংহাই, অ্যায়ম, ফুচাও, নিংগপো চিনের এই পাচটি বন্দর ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্য ও বসবাসের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই বন্দরগুলোতে উইরোপীয়রা নিজ নিজ কনসাল নিয়োগের অধিকার পায়। হংকং বন্দর চিরকালের জন্য ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।

2) বগ এর অসম চুক্তি :- ব্রিটিশ সরকার চিনের ওপর নানকিং এর অসমচুক্তি চাপানোর কিছুকাল পর বগ এর সন্ধি ৮ অক্টোবর, ১৮৪৩ খ্রিঃ নামে অপর একটি অসম চুক্তি চাপিয়ে দেয়। এই সন্ধির দ্বারা ব্রিটেন চিনে কিছু অতিরাষ্ট্রিক অধিকার লাভ করে। এই চুক্তির ফলে বন্দরগুলিতে বসবাসকারী চিনা ও ব্রিটিশ সব অধিবাসীদের ওপর চিনের আইন ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রনের অধিকার লুপ্ত হয়ে ব্রিটিশ আইনও বিচার ব্যবস্থার অধীনে আসে।

3) ওয়াংঘিয়ার অসম চুক্তি :- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৮৪৪ খ্রিঃ ৩ জুলাই চিনের ওপর ওয়াংঘিয়ার অসমচুক্তি চাপিয়ে দেয়। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনে বিভিন্ন অতিরাষ্ট্রিক সুবিধা লাভ করে।

4) হোয়ামপোয়া-র অসম চুক্তি :- ফ্রান্সে ১৮৪৪ খ্রিঃ ২৪ অক্টোবর চিনের ওপর হোয়ামপোয়ার অসমচুক্তি চাপিয়ে দেয়। ফরাসি বণিকদের জন্য চিনের নতুন পাঁচটি বন্দর খুলে দেওয়া হয়। ফরাসি নাগরিকদের অতিরাষ্ট্রিক সুবিধে দেওয়া হয়। চিন ও ফরাসি বণিকদের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক নির্দিষ্ট হয়।

 5) আইগুন-এর সন্ধি :- ১৮৫৬ চিনের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ শুরু হয়। রাশিয়া এই অবস্থায় আইগুন-এর সন্ধি চাপিয়ে দেয়। ২৮ মে, ১৮৫৮ খ্রিঃ চিনের উত্তরাংশে বেশ কিছু ভূ-খন্ড রাশিয়া নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। চিনের আমুর, উসুরি, সংঘুরা জিয়া, নদীতে একমাত্র রাশিয়া ও চিনের নৌ চলাচল স্বীকৃত হয়।

6) তিয়েনসিয়েনের অসম চুক্তি :- দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধের পর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তিয়েনসিয়েনের অসমচুক্তি চাপিয়ে দেয়। ১৮৫৮ খ্রিঃ এর ফলে চিন সরকার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। বিদেশি বণিকদের জন্য চিনের আরও ১১টি বন্দর খুলে দেওয়া হয়। রাজধানী পিকিং-এ বিদেশি দূতাবাসের স্থাপনা করার প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়।

7) পিকিং এর সন্ধি :- ১৮৮৬০ খ্রিঃ চিন এই সন্ধি স্বাক্ষর করে।

8) শিমোনো সেকির সন্ধি :- কোরিয়াকে কেন্দ্র করে ১৮৯৪-৯৫ খ্রিঃ চিপ জাপান যুদ্ধ শুরু হলে চিন পরাস্ত হয় ও জাপানের সঙ্গে শিমোনোসেকির সন্ধি করে। এর শর্তাবলিতে কোরিয়াকে চিন স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। চিনের কাছ থেকে জাপান পেস্কাডোরেস, তাইওয়ান, লিয়াওটুং উপদ্বীপ ও পোর্ট আর্থার লাভ করে।

9) বক্সার প্রোটোকল :- ১৮৯৯-১৯০১ খ্রিঃ মধ্যে চিনে বিদেশি শক্তিদের নির্যাতন, শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে আই-হো-চুয়ান নামে এক গুপ্ত সমিতি বক্সার বিদ্রোহ করে। কিন্তু আটটি বিদেশি দেশের সম্মিলিত বাহিনী মিলিতভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে এবং ১৯০১ খ্রিঃ ৭ সেপ্টেম্বর ১১টি বিদেশি শক্তি বক্সার প্রোটোকল নামে এক চুক্তির মাধ্যমে চিনের ওপর বিভিন্ন কঠোরনীতি চাপিয়ে দেয়। বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী ১২ জন রাজপুরুষের প্রাণদণ্ডসহ শতাধিকের শাস্তি হয়। বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়।

উপসংহার: চিনের ওপর এইসব অসচুক্তিগুলি চাপিয়ে চিনের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করার চেষ্টা করা হয় ও চিনে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা যেসব অতিরাষ্ট্রিক সুযােগসুবিধা লাভ করেছিল তা অন্তত ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বজায় থাকে , এর ফলে চিনকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়। পরবর্তীকালে 1949 খ্রি. চিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য এইসব অতিরাষ্ট্রিক সুযোগসুবিধা বাতিল করা হয়।

Read More