বাংলার সমাজ ও অর্থনীতিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবসমূহ পর্যালোচনা করো।

ভূমিকা: ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড কর্ণওয়ালিশ বিলাতের পরিচালক সভার অনুমোদন লাভের পর দশশালা বন্দোবস্তকে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করেন। এই ব্যবস্থা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় চালু হয়। বাংলার ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা, এই ব্যবস্থা বাংলার সমাজ ও অর্থনীতিতে চরম প্রভাব বিস্তার করেছিল।

বাংলার সমাজ ও অর্থনীতিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবসমূহ পর্যালোচনা করো

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবসমূহ :-

  • ১) কৃষকদের উচ্ছেদ: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারকে জমির স্থায়ী মালিকানা দেওয়া হলেও জমিতে কৃষকদের কোনো অধিকার ছিল না। ফলে জমিদার বেশি রাজস্ব পাওয়ার আশায় চাষিকে ঘন ঘন জমি থেকে উৎখাত করত। চাষির রাজস্ব বাকি পড়লে জমিদার সেই চাষির জিনিসপত্র নিলাম করত। এজন্য পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা কৃষকরা জমিদারের ভাড়াটে মজুরে পরিণত হয়।
  • ২) জমির উন্নতি ব্যাহত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা চায়িরা জমির মালিকানা না পাওয়ায় তারা জমির উৎপাদনে উৎসাহ হারায়। জমিদাররাও জমির উর্ববরতা বৃদ্ধি, কৃষির প্রসার, সেচব্যবস্থার উন্নতি, পতিত জমির উদ্ধার প্রভৃতির জন্য অর্থ ব্যয় না করে নিজেদের বিলাস ব্যসনেই অর্থ ব্যয় করত। এতে বাংলার কৃষি অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।
  • ৩) কৃষকদের দূরবস্থা: অতিরিক্ত রাজশ্বের বোঝা ও আদায়ের কঠোরতা বাংলা কৃষককুলকে সর্বস্বান্ত করেছিল। নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আদায়ের ফলে কৃষকদের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে ওঠে। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদাররা সরকারকে ৩৫ লক্ষ পাউন্ড রাজস্ব দেওয়ার প্রতিশ্র“তি দেন। কিন্তু ওই বছর জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ আদায় করেন ১ কোটি ৩৫ লক্ষ পাউন্ড।
  • ৪) কৃষি শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষতি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় শহরের মানুষ ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে জমিদারি ক্রয়ের দিকে ঝুকে পড়ে। সরকারের শিল্পনীতি বাংলার কুটিরশিল্পের ধ্বংশ ডেকে আনে। এভাবে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
  • ৫) মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে পত্তনি প্রথার মাধ্যমে বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ধব হয়। সামাজিক কাঠামোগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ড. তারাচাঁদ মনে করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলা তথা ভারতের সামাজিক সংগঠন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। ভারতের চিরাচরিত গ্রামীণ সংগঠন ধ্বংশ হয়, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদে সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। নতুন সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং গ্রামাঞ্চলে সামাজিক বিপ্লব ঘটে। চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের মাধ্যমে একদিকে নব্য জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ী প্রভৃতি নতুন মধ্যবিত্ত শেণির উদ্ভব ঘটে। অন্যদিকে গ্রামীণ কৃষক ও কারিগররা ভূমিহীন মজুরে পরিণত হয়।

উপসংহার : উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে আমরা এটা বলতে পারি যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আসার পর বাংলায় ব্যাপকভাবে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় । এর ফলে সমাজ কাঠামোতে শ্রেণীবিন্যাস ঘটতে দেখা যায়, এতে শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে তার ফলে ব্রিটিশ উপনিবেশ এর অবসান ঘটাতে সফলতা লাভ করে ।

====>>> আইনের প্রমুখ উৎস গুলি