হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এবং যুদ্ধোত্তর কালে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বান্দোচিন বিশেষ করে ভিয়েতনামের স্বাধীনতার যুদ্ধে ছিল একাধারে উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রাম এবং এশিয়ার ভূমিতে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির বিপজ্জনক বহিঃ প্রকাশের দৃষ্টান্ত। আর ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের প্রধান নায়ক ছিলেন জাতীয়তাবাদী কমিউনিস্ট নেতা নগুয়েন আই কুয়োগ যিনি হো-চি-মিন নামেই প্রসিদ্ধ।
হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
- হো-চি-মিনের কৃতিত্ব- ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দের মহামন্দার কারণে চাল ও রবারের চাহিদা ও মূল্য হ্রাস পাওয়ায় ইন্দোচিনের সঙ্কটাপন্ন কৃষকরা ঔপনিবেশিক ফরাসি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এই পরিস্থিতিতে হো-চি-মিন দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে সংঘবদ্ধ করে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। হো-চি-মিন ও তার দলের নেতৃত্বে ভিয়েতনামি জনতা ফরাসি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম চালান। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন লিগ ফর দি ইন্ডিপেন্ডেন্স ইন ভিয়েতনাম বা ভিয়েতমিন ও গরিলা যুদ্ধে দকক্ষ একটি গুপ্ত সমিতি।
- মুক্তি সংগ্রামের প্রথম পর্যায়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জাপানের আত্ম সমর্পন কালে মিত্রশক্তি ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পটসডাম সম্মেলনে ইন্দোচিনে দ্বিধা বিভক্ত করলে কুয়োমিনতাং চিনের উত্তর ইন্দোচিন হো-চি-মিনকে ভিয়েতনামের স্বাধীনতার জন্য অর্পন করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রান্স সমগ্র ইন্দোচিনে পুনরায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার তৎপর হয়। যদিও বারং বার চেষ্টা সত্তে¡ও ভিয়েতমিনের হাতে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হয়। এমনকি দিয়েন বিয়েন ফু নামক স্থানে ফরাসি অস্ত্রভান্ডার ও নগুয়েন গিয়াপের নেতৃত্বে ভিয়েতমিন ধবংশ করে। এই পরিস্থিতিতে উভয়পক্ষ শান্তিপূর্ণ মিমাংসার পথে অগ্রসর হয় এবং ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ‘জেনেভা সম্মেলনে’ ভিয়েতনামকে দ্বিধাবিভক্ত করে উত্তরাঞ্চলে ভিয়েতমিন ও দক্ষিনাঞ্চলে ফরাসি আধিপত্য প্রদান করা হয়। লাওস ও কম্বেডিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।
- ভিয়েতনাম যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়– মার্কিন অণুগ্রহপুষ্ট ও ফরাসি নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের ন-দিন-দিয়েন সরকার ছিল স্বৈরাচারী। ফলে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এই সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়ে ওঠে। উত্তর ভিয়েতনামের মদতপুষ্ট এই ফ্রন্টকে ‘দিয়েন ভিয়েন কং’ আখ্যা দিয়ে সংঘর্ষ শুরু করেন। উলেখ্য যে প্রত্যক্ষ মার্কিন সহযোগিতা সত্তে¡ও ভিয়েতনামে দিয়েন সরকারের পতন ঘটে। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল নগুয়েন ভিন থিউ দক্ষিণ ভিয়েতনামের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন।
- মার্কিন উগ্রতা– ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভিয়েতনামে প্রত্যক্ষ মার্কিন হস্তক্ষেপ বাড়তে থাকে। ভিয়েত কংদের উপর তীব্র আক্রমন শানিয়ে মার্কিন সেনারা বিষাক্ত গ্যাস ও বিস্ফোরক দ্বারা নীরিহ প্রাণ ও উদ্ভিদ ধবংশ করে। মাইলাই গ্রামে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সেনারা শিশু ও বৃদ্ধ সহ ৪০০ থেকে ৪৫০ জনকে হত্যা করে যা ‘মাইলাই ঘটনা’ নামে পরিচিত। এর পরিপ্রেক্ষিপ্তে ভিয়েতকং ও উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী একযোগে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ৪৪টি প্রাদেশিক রাজধানী শহরে আক্রমন চালায়। শুরু হয় জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আমেরিকার অভ্যন্তরেও মার্কিন রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসনের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন এর সময় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েতনাম ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রায় সমগ্র অঞ্চল ভিয়েত কংদের দখলে আসে।
- ভিয়েতনামের ঐক্য ও পূর্ণ স্বাধীনতা– ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে দক্ষিণ ভিয়েতনামের জেনারেল ভ্যান মিন সায়্যানে মুক্তিবাহিনী বা ভিয়েত কংদের কাছে আত্মসমর্পন করেন। এরপর ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রথম রাষ্ট্রপতি হন ফাম-ভান-দং।
===>>> আইনের প্রমুখ উৎস