জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপট কী ছিল ও ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল ?

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কুখ্যাত রাওলাট আইন পাশ হলে এই আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদের তীব্র ঝড় ওঠে। এর মধ্যে পাঞ্জাবে রাওলাট আইন সহ ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। ফলে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি খুবই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। এর চূড়ান্ত এবং সবচেয়ে করুণ পরিণতি ঘটে জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়াবহ হত্যাকান্ডে।

ভারত শাসন আইনে

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপট

  • ১) পাঞ্জাবে অত্যাচার– পাঞ্জাবের মুখ্য প্রশাসক মাইকেল ও ডায়ার-এর অত্যাচারী শাসন পাঞ্জাবকে বারুদের স্তুপে পরিণত করে। জুলুম চালিয়ে যুদ্ধের জন্য পাঞ্জাব থেকে সেনা ও অর্থ সংগ্রহ করা, ‘গদর’ বিদ্রোহ প্রতিরোধ করতে পাঞ্জাবিদের ওপর চরম নির্যাতন, বঞ্ছনার প্রতিবাদে বেকার শিখ সৈন্যদের সমাবেশ প্রভৃতি ঘটনা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের মানুষকে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ করে তোলে।
  • ২) রাওলাট আইনের প্রয়োগ – সরকার ভারতীয়দের যাবতীয় স্বাধীনতা ও অধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে দমনমূলক রাওলাট আইন প্রবর্তন করলে দেশবাসী ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস থেকে এই ক্ষোভ পাঞ্জাবে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
  • ৩) নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার – ‘পিপলস কমিটি’ নামে একটি গণ সংগঠন লাহোর ও অমৃতসরে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এই পরিস্থিতিতে সরকার ১০-ই এপ্রিল ১৯১৯ অমৃতসরের স্থানীয় দুই নেতা সৈফুদ্দিন কিচলু ও ডঃ সত্যপালকে হিংসার মদত দেওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার করলে জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে গান্ধিজিকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে লাহোরে বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত, টেলিফোন লাইন, ইউরোপীয় নারী পুরুষের ওপর আক্রমন চালায়।
  • ৪) অমৃতসরে সামরিক শাসন জারি – অমৃতসরে আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর হাতে অমৃতসর শহরের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়। সামরিক আইন জারি করে ১১ ই এপ্রিল সেই শহরে জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এর প্রতিবাদে ১৩ ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক এক বাগানঘেরা অঞ্চলে নিরস্ত্র আবাল বৃদ্ধবণিতা সমবেত হলে ডায়ারের নির্দেশে ১৬০০ রাউন্ড গুলি চলে, তাতে ৩৭৯ জন নিহত ও ১২০০ জন আহত হয়, যা জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড নামে পরিচিত।

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া

জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়ানক ও মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনায় ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্নরূপটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। সরকার জেনারেল ডায়ারের কাজকে সমর্থন করে। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় গোটা বিশ্ব শিহরিত হয়। দেশে বিদেশে সর্বত্র সরকারের নগ্ন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র বলেছেন যে, “পাঞ্জাবের ঘটনা দেশের মানুষের কাছে সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের মুখোশধারী বিদেশী শাসনের কুৎসিত ও ভয়াবহ রূপটি প্রকাশ করে দেয়।”

  • ১) ক্ষোভ প্রকাশ – জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের ঘটনার প্রতিবাদে দেশের সর্বত্র ঘৃনা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বলেছেন যে, “এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ভারতে যে মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় তা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে সবার হৃদয়কে আন্দোলিত করে।”
  • ২) উপাধি ত্যাগ – জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘৃন্য ও বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। গান্ধিজি ইংরেজদের দেওয়া ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ উপাধি ত্যাগ করেন।
  • ৩) কংগ্রেসের প্রতিবাদ – জাতীয় কংগ্রেস এই হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা করে। কংগ্রেস নেতা সি. এফ. এন্ড্রুজ এই ঘটনাকে ‘কসাই খানার গণহত্যার’ সমতুল্য বলে নিন্দা করেন। গান্ধিজি তাঁর ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় লেখেন যে, “এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে অবশ্যই ধবংশ করতে হবে।”
  • ৪) ইংরেজদের প্রতিবাদ – এই হত্যাকান্ডের ঘটনাকে বহু ইংরেজও অত্যন্ত মর্মান্তিক ও নজির বিহীন বলে নিন্দা করেন। ভাবী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বলেছিলেন, “জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে আর কখনও ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। এই ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক, পাশবিক।

====>>>> ভারত শাসন আইন